নিজস্ব প্রতিবেদক.
২০১৫ সালের এক গৃহবধূকে হত্যার ঘটনা তদন্ত করে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে ভিকটিমের বাবাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পিবিআই জানায়, নিজ হাতে মেয়েকে খুন করে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করে বার বার নারাজী এবং পরে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে মামলা করে ওই গৃহবধূর বাবা। তদন্ত শেষে বাবা আ. কুদ্দুছ খাঁকে (৫৮) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কুদ্দুছ শুক্রবার আদালতে জবানবন্দি দেন এবং এই লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেন।
রোববার ধানমন্ডি পিবিআই সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ঘটনার শুরু ২০১২ সালে। সেই বছর কুদ্দুছ খাঁর মেয়ে পারুল আক্তার টাঙ্গাইলের কালিহাতির একই এলাকার মো. নাছির উদ্দিন বাবুকে (১৯) ভালবেসে ঢাকায় পালিয়ে এসে বিয়ে করে।
এই ঘটনায় কুদ্দুছ খাঁ ২০১২ সালে কালিহাতি থানায় জিডি করেছিলেন। উভয়ের পরিবার বিয়ে মেনে না নেয়ায় তারা ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়ায় বসবাস শুরু করে।
চাকরি নেয় পোশাক কারখানায়। তাদের পারিবারিক অশান্তি চলতে থাকে। পারুল তার বাবাকে ফোন করে পারিবারিক অশান্তির কথা জানায়।
বাবা ভালো ছেলে দেখে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে উন্নত জীবন যাপনের লোভ দেখায় মেয়েকে।
২০১৫ সালের ১৮ জুলাই নাসির তার নানিকে দেখতে যায়। সেই সুযোগে বাবার দেয়া আশ্বাসে পারুল ১৯ জুলাই তার বাবাকে ফোন করে টাঙ্গাইলে যায়।
একই দিন পারুল আক্তারের স্বামী নাসির উদ্দিন আ. কুদ্দুছ খাঁর বিরুদ্ধে মেয়েকে বাবার বাড়ি পালিয়ে যেতে প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে আশুলিয়া থানায় জিডি করে।
কুদ্দুছ খাঁ তার মেয়েকে নিজ বাড়িতে না নিয়ে বন্ধু মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মন্ডলের বাড়ি ভুঞাপুরে নিয়ে যায়।
সেখান থেকে মোকা মন্ডল ভবিষ্যতে পারুলকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং কিছুদিন নাসির উদ্দিনের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে হবে এই আশ্বাস দিয়ে জয়পুরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকায় একটি নদীর পাশে নির্জন জায়গায় রাতের অন্ধকারে পারুলকে তার বাবা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে মোকা মন্ডলের সহযোগিতায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।
পিবিআই প্রধান বলেন, আসামির ১৬৪ ধারা বর্ণনা অনুসারে তারা ৩ জন রাতের অন্ধকারে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে থাকে।
মেয়ের ইতোপূর্বের কার্যকলাপের অপমান বোধ থেকে রাগে বাবা মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর মেয়ের ওড়না ২ টুকরা করে বাবা মেয়ের হাত এবং মোকা মন্ডল পা বাঁধে। বাবার নিজের গামছা দিয়ে মেয়ের গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে তারা পারুলের মরদেহ নদীতে ফেলে দিয়ে টাঙ্গাইলে চলে আসে। ৪ অগাস্ট ২০১৫ নাসির উদ্দিনের পরিবারের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলের আদালতে মামলা করে।
কালিহাতি থানা পুলিশ তদন্ত করে প্রেম করে বিয়ে করার সংশ্লিষ্টতা পায়। কিন্তু পারুলকে না পওয়ায় ঘটনাস্থল তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত এলাকা (ঢাকায়) বলে প্রতিবেদন দাখিল করে। বাদীর বার বার নারাজির প্রেক্ষিতে ডিবি পুলিশ, টাঙ্গাইল পিবিআই, টাঙ্গাইল সিআইডি তদন্ত করে একই প্রতিবেদন দেয়।
তিনি বলেন, সবশেষে আদালত জুডিশিয়াল তদন্ত করে রিপোর্ট দেয় যে, বাদী ঢাকার আদালতে মামলা করলে প্রতিকার পেতে পারে।
গত বছরের ২৭ নভেম্বর কুদ্দুছ খাঁ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আদালতে উপরোক্ত তদন্তের রেফারেন্সসহ নারী নির্যাতন দমন আইনে অর্থাৎ যৌতুকের জন্য মারপিট করে হত্যা মামালার আবেদন করে। ৩০ নভেম্বর আদালত আশুলিয়া থানাকে মামলা নথিভুক্ত করতে এবং পিবিআই ঢাকা জেলাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। আশুলিয়া থানায় ১১ ডিসেম্বর মামলা দায়ের করা হলে পিবিআই ঢাকা জেলা তদন্ত শুরু করে।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, পিবিআই নাসির উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। ইতোমধ্যে বাদীকে ডাকা হয়। বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি অসামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য প্রদান করেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন যে, তিনি নিজেই তার মেয়েকে হত্যা করেছেন। তার দেয়া তথ্য যাচাই করার জন্য পিবিআই জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানা থেকে ২০১৫ সালের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে।
পাঁচবিবি থানার করা মামলার আলামত, সুরতহালের বর্ণনা এবং পোস্টমর্টেম প্রতিবেদনের সঙ্গে আ. কুদ্দুছ খাঁর বর্ণনার মিল পাওয়া যায়। ৫৪ ধারায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালত ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।
জবানবন্দিতে তিনি হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা এবং তার বন্ধু মোকাদ্দেছ মোকা মন্ডলের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছেন। মোকা মন্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তিনি জানান। শীঘ্রই তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই বিশ্বজিৎ বিশ্বাস বলেন, কুদ্দুছ খাঁ কৃষি কাজ করে, তার আরো তিন মেয়ে আছে। পালিয়ে বিয়ে করার ক্ষোভ থেকেই এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে তিনি।